দেবব্রত দত্ত: ঢাকায় মেট্রোরেল প্রকল্প এখন দৃশ্যমান বাস্তবতা। অনেক স্থানেই এই রেললাইন স্থাপনের জন্য পিলার বসে গেছে। কোথাও কোথাও কাজ আরও বেশি এগিয়ে। শিগগিরই নগরবাসী এর আরও বাস্তব রূপ দেখতে পাবে।’ ঢাকা শহর নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি এমন আশার বাণী শুনিয়েছেন।
যানজট আর পরিবহন সংকট থেকে মুক্তি দিতে এই শহরে তৈরি হচ্ছে মেট্রোরেল। সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক এই প্রকল্প এগিয়ে চলেছে। উত্তরার দিয়াবাড়ী থেকে মতিঝিল পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে মেট্রোরেলের লাইনের (এমআরটি-৬) কাজ সংশ্লিষ্ট সড়কে দৃশ্যমান। বিশেষ উদ্যোগে ২০১৯ সালে উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত সচল হবে এই রেল। আর ২০২০ সালের মধ্যে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চলবে। এই পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বর্তমানে উত্তরা থেকে মতিঝিল যেতে সময় লাগে তিন থেকে চার ঘণ্টা। মেট্রোরেল সেটা কমিয়ে আনবে ৩৭ মিনিটে। প্রতিটি স্টেশনে প্রতি ৩.৩৭ মিনিটে উভয় দিকে ট্রেন থামবে এবং সম্পূর্ণ এলিভেটেড ও বিদ্যুৎচালিত ট্রেন প্রতি ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করবে। এভাবে ট্রেনটি প্রতিদিন ৫ লাখ যাত্রী পরিবহন করতে পারবে।
জানা যায়, রাজধানী ঢাকার যানজট নিরসনে ২০১২ সালে প্রকল্পটি অনুমোদন দেয় সরকার। ২০২৪ সালের মধ্যে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ১৬টি স্টেশনের নির্মাণকাজ শেষ করার কথা থাকলেও ২০১৯ সালের মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত অন্তত ৯টি স্টেশনের কাজ শেষ করার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। আর আগারগাঁও থেকে মতিঝিল শাপলা চত্বর পর্যন্ত বাকি সাতটি স্টেশনের কাজ শেষ হবে ২০২০ সালের মধ্যে। এই প্রকল্পের মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা।
আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ২৪ সেট মেট্রোরেল নিয়ে শুরু হবে এমআরটি লাইন-৬ এর যাত্রা। প্রতি সেট মেট্রোরেলে প্রাথমিকভাবে ৬টি করে কোচ থাকবে। তবে পরে আরো ২টি কোচ যোগ করে কোচের সংখ্যা ৮টিতে উন্নীত করার ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। মেট্রোরেলের সুষ্ঠু পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে একটি অত্যাধুনিক অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টার থাকবে।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) বৃহত্তর ঢাকার জন্য পাঁচটি ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিটের (এমআরটি) বাস্তবায়ন করছে। এরই ধারাবাহিকতায় উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার মেট্রোরেল সিস্টেম চালু হবে। এই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে এমআরটি লাইন-৬। পুরোদমে এর কাজ চলছে।
এমআরটি লাইন-৬ রুটে মোট ১৬টি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। মেট্রোরেলের প্রথম স্টেশন হবে উত্তরা নর্থ, তার পর যথাক্রমে উত্তরা সেন্টার, উত্তরা দক্ষিণ, পল্লবী, মিরপুর-১১, মিরপুর-১০, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয় হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত এই ট্রেন চলাচল করবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এমআরটি লাইন-৬ কে মোট আটটি প্যাকেজে বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। প্যাকেজ-১ ডিপো এলাকার ভূমি উন্নয়নের কাজ দেওয়া হয়েছিল টোকিও কনস্ট্রাকশনকে, তারা শতভাগ কাজ শেষ করেছে। প্যাকেজ-২ ডিপো এলাকার পূর্ত কাজ দেওয়া হয়েছিল আইটিডি এবং সিনোহাইড্রোকে। তারা এই কাজের ২০ ভাগ শেষ করেছে। প্যাকেজ-৩ ও ৪ উত্তরা নর্থ থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১.৭৩ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও ৯টি স্টেশন নির্মাণের কাজ আইটিডিকে দেওয়া হয়েছিল। তারা সেই কাজের প্রায় ২৫ ভাগ শেষ করেছে। প্যাকেজ-৫ আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত ৩.২০ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও ৩টি স্টেশন নির্মাণ কাজ দেওয়া হয়েছে টেককেন, আবদুল মোনেম এবং আবেনি জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানিকে। তারা এই কাজ শুরু করেছে। প্যাকেজ-৬ কারওয়ান বাজার থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৪.৯২ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও ৪টি স্টেশন নির্মাণের কাজ গত ১ আগস্ট থেকে শুরু করেছে। প্যাকেজ-৭ ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড মেকানিক্যাল সিস্টেমের কাজ দেওয়া হয়েছে এলএন্ডটি এবং মারুবিনিকে। তারা এই কাজের প্রায় ২২ ভাগ শেষ করে ফেলেছে। প্যাকেজ-৮ রেল কোচ ও ডিপো ইক্যুইপমেন্ট সংগ্রহের কাজ দেওয়া হয়েছে মিৎসুবিশি ও কাওয়াসাকিকে। তারা এই কাজের প্রায় ২২ ভাগ ইতিমধ্যে শেষ করে ফেলেছে।
মেট্রোরেলের কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) উপ-প্রকল্প পরিচালক খান মো. মিজানুল ইসলাম এই সময়কে বলেন, সার্বিক কাজের প্রায় ২০ ভাগ শেষ হয়েছে।
যা থাকবে
মেট্রোরেলে যারা ভ্রমণ করতে চাইবেন, তাদের জন্য থাকবে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বিত সেবা। মেট্রোরেলের স্টেশনগুলো হবে উঁচু (এলিভেটেড)। এর টিকিট কাউন্টার ও অন্যান্য সুবিধা থাকবে দোতলায়। ট্রেনের প্লাটফর্ম থাকবে তিনতলায়। সব স্টেশনে থাকবে লিফট, চলন্ত সিঁড়ি, সার্বক্ষণিক সিসিটিভি ক্যামেরা। প্রবেশপথ থেকে স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় টিকিট সংগ্রহ করা যাবে। সব ক্ষেত্রেই সর্বাধুনিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। র্যাপিড পাস ব্যবহার করে যাত্রীরা নির্বিঘেœ মেট্রোরেলে যাতায়াত করতে পারবেন। যাত্রী-নিরাপত্তা নিশ্চিতে স্টেশনের প্লাটফর্মে নিরাপত্তা বেষ্টনী বসানো হবে। পরিবেশবান্ধব মেট্রোরেলের কোচগুলো হবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। থাকবে সুবিন্যস্ত আসনব্যবস্থা। রাখা হবে যাত্রা-সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্যসংবলিত ডিসপ্লে-প্যানেল। হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী যাত্রীদের জন্য প্রতিটি ট্রেনের কোচগুলোতে থাকবে নির্ধারিত স্থান। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে মেট্রোরেলের থাকবে নিজস্ব বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা।
সড়কের মাঝ বরাবর ভূমি থেকে প্রায় ১৩ মিটার ওপর দিয়ে নির্মিত এলিভেটেড মেট্রোরেল চলাচল করবে। এর কম্পন নিয়ন্ত্রণের জন্য থাকবে বিশেষ ব্যবস্থা। শব্দ নিয়ন্ত্রণের জন্য শব্দ নিরোধক দেয়াল স্থাপন করা হবে। এসব উদ্যোগ রুটে থাকা ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোকে সম্ভাব্য সব ধরনের বিরূপ প্রভাব থেকে সুরক্ষা দেবে। মেট্রোরেল অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টার থেকে প্রতিটি ট্রেনকে নিয়ন্ত্রণ করা হবে। তারপরও চালক থাকবে। একটি ট্রেনের সঙ্গে আরেকটির কখনো মুখোমুখি সংঘর্ষ হবে না। সামনের ট্রেনটি থেমে গেলে পেছনেরগুলো অটোমেটিক বন্ধ হয়ে যাবে।
আরও কিছু রুট
এমআরটি লাইন-৬ এর কাজের পাশাপাশি এমআরটি লাইন-৫ বাস্তবায়িত হবে। এর দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ছয় কিলোমিটার। রুট হচ্ছে: হেমায়েতপুর-গাবতলী-টেকনিক্যাল-মিরপুর ১-মিরপুর ১০-মিরপুর ১৪-কচুক্ষেত-বনানী-গুলশান ২-নতুন বাজার-ভাটারা। হেমায়েতপুর-ভাটারা এই রুট ২০২৭ সালের মধ্যে আন্ডারগ্রাউন্ড ও এলিভেটেড সমন্বয়ে ১৯.৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ মেট্রোরেল নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এর প্রস্তাবিত স্টেশন হচ্ছে: হেমায়েতপুর, বালিয়ারপুর, মধুমতি, আমিনবাজার, গাবতলী, দারুসসালাম, মিরপুর-১, মিরপুর-১০, মিরপুর-১৪, কচুক্ষেত, বনানী, গুলশান-২, নতুন বাজার, ভাটারা। এলিভেটেড সেকশন: হেমায়েতপুর হতে আমিনবাজার এবং নতুন বাজার হতে ভাটারা পর্যন্ত (মোট ৬ কিলোমিটার) নগর এলাকাতে আমিনবাজার হতে নতুন বাজার পর্যন্ত মেট্রোরেল আন্ডারগ্রাউন্ড দিয়ে যাবে (মোট ১৩.৬ কিলোমিটার)।
এমআরটি লাইন-২ নতুন বাজার, যমুনা ফিউচার পার্ক, বসুন্ধরা, পুলিশ অফিসার্স, হাউজিং সোসাইটি, মাস্তুল, পূর্বাচল পশ্চিম, পূর্বাচল সেন্টার থেকে পূর্বাচল ডিপো পর্যন্ত যাবে। এ লাইনের মোট দৈর্ঘ্য হলো ১০.২০ কিলোমিটার এবং সম্পূর্ণ অংশ এলিভেটেড। মোট স্টেশন সংখ্যা ৯টি এবং এর মধ্যে ৭টি হবে এলিভেটেড।
এমআরটি লাইন-১ বিমানবন্দর রুটে অর্থাৎ বিমানবন্দর টার্মিনাল ৩-খিলক্ষেত-যমুনা ফিউচার পার্ক, নতুন বাজার, উত্তরা, বাড্ডা, হাতিরঝিল, রাজারবাগ হয়ে কমলাপুর যাবে। এর লাইনের দৈর্ঘ্য হবে ১৬.৪০ কিলোমিটার এবং সম্পূর্ণ অংশ আন্ডারগ্রাউন্ড। মোট স্টেশনের সংখ্যা ১২টি। সূত্রঃ ঢাকা টাইমস।